পুরনো দিনে জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা
পুরনো দিনে জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা
বাংলার গ্রামীণ জীবনে খেলাধুলা ছিল শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে পুরনো দিনে, যখন আধুনিক প্রযুক্তি, ইন্টারনেট বা ভিডিও গেমস ছিল না, তখন গ্রামীণ এলাকায় মানুষ অবসর সময়ে বা উৎসবের মৌসুমে নানা ধরনের খেলায় অংশ নিত। এই খেলাগুলো শুধু শরীরকে সক্রিয় রাখত না, বরং পারস্পরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বও মজবুত করত। আজ আমরা সেসব পুরনো দিনের জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলার কথা স্মরণ করব, যেগুলো একসময় গ্রামবাংলার আঙিনা, মাঠ ও মেলার প্রাণ ছিল।
১. কানামাছি খেলা
কানামাছি ছিল গ্রামের শিশুদের অন্যতম প্রিয় খেলা। এই খেলায় একজন খেলোয়াড়ের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হতো, আর অন্যরা চারপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইত বা নানাভাবে তাকে বিভ্রান্ত করত। চোখ বাঁধা খেলোয়াড়কে অনুমান করে অন্য কাউকে ধরতে হতো। এটি ছিল মজার পাশাপাশি মনোযোগ, শ্রবণশক্তি ও অনুমানের দক্ষতা বৃদ্ধির একটি চমৎকার উপায়।
২. লাঠিখেলা
লাঠিখেলা ছিল একসময় গ্রামীণ যুবকদের সাহস, শক্তি ও কৌশল প্রদর্শনের মাধ্যম। লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার ভঙ্গি শেখা হতো। অনেক সময় মেলা, উৎসব বা বিশেষ দিনে লাঠিখেলার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতো। এটি শুধু বিনোদনই নয়, আত্মরক্ষার একটি প্রাচীন কৌশল হিসেবেও জনপ্রিয় ছিল।
৩. দাড়িয়াবান্দা
দাড়িয়াবান্দা শিশু ও কিশোরদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। মাঠে বা খোলা জায়গায় লাইন কেটে খেলার স্থান ভাগ করে নেওয়া হতো। খেলোয়াড়দের দল ভাগ করে একজন দল প্রতিপক্ষকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত, আর অন্যরা লাইন অতিক্রম করে দৌড়ে যেতে চাইত। এতে দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতা ও কৌশলী পরিকল্পনার প্রয়োজন হতো।
৪. কাবাডি
বাংলার ঐতিহ্যবাহী দলগত খেলাগুলোর মধ্যে কাবাডি অন্যতম। এই খেলায় শারীরিক শক্তি, সহনশীলতা ও নিঃশ্বাস ধরে রাখার দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। খেলোয়াড় প্রতিপক্ষ দলের এলাকায় প্রবেশ করে ‘কাবাডি কাবাডি’ বলতে বলতে তাদের ছুঁয়ে ফিরে আসতে চেষ্টা করত। কাবাডি আজও বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে স্বীকৃত, তবে গ্রামীণ জীবনে এটি একসময় ছিল উৎসবের প্রধান আকর্ষণ।
৫. গোল্লাছুট
গোল্লাছুট একটি সহজ কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এতে একজন খেলোয়াড় নির্দিষ্ট স্থানে থেকে অন্যদের ধরার চেষ্টা করত, আর অন্যরা একে অপরের সাথে পাল্টাপাল্টি দৌড়ে সেই স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করত। এই খেলায় দলগত সমন্বয় ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া খুবই জরুরি ছিল।
৬. বউচি
বউচি খেলায় একজন খেলোয়াড় ‘বউ’ হিসেবে লুকিয়ে থাকত, আর অন্যরা তাকে রক্ষা করত। প্রতিপক্ষ দলের সদস্যরা ‘বউ’ ধরার চেষ্টা করত। এটি শিশুদের কাছে দারুণ মজাদার ছিল এবং খেলার সময় মাঠজুড়ে হাসি-ঠাট্টা লেগেই থাকত।
৭. গুটি খেলা
গুটি খেলা বা গুটি-ডাঙ্গুলি ছিল গ্রামের কিশোরদের প্রিয় খেলার একটি ধরন। ছোট কাঠি ও বড় কাঠি ব্যবহার করে দূরে ছোড়া ও লক্ষ্যভেদ ছিল এর মূল নিয়ম। এতে হাত-চোখের সমন্বয় ও মনোযোগ বৃদ্ধির সুযোগ ছিল।
৮. কাঁচের গুলি খেলা
কাঁচের গুলি বা মার্বেল খেলা ছিল ছেলেদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিভিন্ন নিয়মে মাটিতে গোল করে গুলি ছোড়া হতো। এটি ছিল সস্তা কিন্তু অনেক আনন্দদায়ক একটি খেলা।
খেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
পুরনো দিনের এই খেলাগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং গ্রামীণ সমাজে মিলনমেলার সুযোগ তৈরি করত। ঈদ, পূজা, নববর্ষ বা গ্রামীণ মেলায় এসব খেলা আয়োজন করা হতো। এতে গ্রামবাসীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার সুন্দর সমন্বয় দেখা যেত। তাছাড়া, এই খেলাগুলো শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখতে এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
উপসংহার
আজকের আধুনিক জীবনে এসব খেলার প্রচলন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। মোবাইল, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের যুগে শিশু-কিশোররা মাঠের খেলাধুলার চেয়ে ঘরোয়া ডিজিটাল বিনোদনে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। তবে আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা, যাতে নতুন প্রজন্মও গ্রামীণ জীবনের আনন্দ ও সামাজিক বন্ধনের স্বাদ পায়। পুরনো দিনের এই খেলাগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ, আর সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর সাথে জড়িত বিনোদনের মাধ্যমগুলোও সংরক্ষণ করা জরুরি।