ক্রিকেট খেলায় টসের গুরুত্ব কতটা?
ক্রিকেট খেলায় টসের গুরুত্ব কতটা?
ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে প্রতিটি ছোট সিদ্ধান্তও ম্যাচের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। এর মধ্যে টস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খেলার শুরুতে কয়েন উল্টে নির্ধারিত এই প্রক্রিয়া অনেক সময় ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে সক্ষম। টসের মাধ্যমে অধিনায়ক ঠিক করেন তার দল প্রথমে ব্যাট করবে না বোলিং করবে। এই একটি সিদ্ধান্ত মাঠ, আবহাওয়া, পিচ ও ম্যাচ ফরম্যাটের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। তাই টস জয়কে অনেকেই ম্যাচ জয়ের প্রথম ধাপ হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
টসের কৌশলগত গুরুত্ব
একটি ম্যাচের পরিস্থিতি অনেকাংশে নির্ভর করে পিচের অবস্থা এবং আবহাওয়ার ওপর। উদাহরণস্বরূপ—
-
উপমহাদেশের গরম আবহাওয়ায় দুপুরে ব্যাট করা তুলনামূলক সহজ হলেও, বিকেলে পিচ ধীরে ধীরে মন্থর হয়ে পড়ে এবং স্পিনারদের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে।
-
ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডে সকালের আর্দ্র আবহাওয়ায় বল বেশি সুইং করে। তাই সেখানে টস জিতে আগে ফিল্ডিং নেওয়াই অনেক সময় বুদ্ধিমানের কাজ।
অধিনায়কের জন্য টস শুধু একটি সুযোগ নয়, বরং সঠিক কৌশল ঠিক করার প্রথম পদক্ষেপ।
টেস্ট ক্রিকেটে টসের প্রভাব
টেস্ট ম্যাচে টসের গুরুত্ব অন্য সব ফরম্যাটের তুলনায় বেশি। কারণ পাঁচ দিনের দীর্ঘ ম্যাচে পিচ প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়। সাধারণত প্রথম দুই দিন ব্যাটিংয়ের জন্য সুবিধাজনক হলেও, চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে পিচ ভেঙে পড়ে, বল অস্বাভাবিক আচরণ করে এবং ব্যাটসম্যানদের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
উদাহরণ:
২০১৬ সালে ভারত–ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে চেন্নাই টেস্টে ভারত টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৭৫৯ রান তোলে। পরে ইংল্যান্ড সেই স্কোরের চাপ সামলাতে না পেরে ম্যাচ হেরে যায়। এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে টস জয় মানেই বড় সুযোগ।
আইসিসির একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টেস্ট ক্রিকেটে প্রায় ৩৪% ম্যাচে টস জেতা দল শেষ পর্যন্ত জিতেছে, আর টস হারানো দলের জয়ের হার প্রায় ২৮%। অর্থাৎ সামান্য হলেও টস ম্যাচের ফলাফলে প্রভাব ফেলে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে টস
ওয়ানডে ম্যাচে টসের ভূমিকা কিছুটা কম হলেও তা অবহেলা করার মতো নয়। অনেক সময় মাঠের আলো, শিশির, কিংবা দ্বিতীয় ইনিংসে চাপ—এসব কারণে টসের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
উদাহরণ:
২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারত টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং নিতে চেয়েছিল। যদিও টস নিয়ে সামান্য বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচে শ্রীলঙ্কা আগে ব্যাট করে। ভারত বড় লক্ষ্য তাড়া করেও জিতে যায়, কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের মতে যদি ভারত প্রথমে ব্যাট করত তবে চাপ অন্যরকম হতে পারত।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে টস ও শিশির ফ্যাক্টর
টি-টোয়েন্টি ম্যাচে টসের সবচেয়ে বড় প্রভাব আসে ডিউ ফ্যাক্টর বা শিশির থেকে। রাতে শিশির পড়লে মাঠ ভিজে যায়, ফলে বল গ্রিপ করতে বোলারদের সমস্যা হয়। একই সঙ্গে ফিল্ডারদের হাত থেকে বল ফসকে যায়। এজন্য অধিকাংশ অধিনায়ক টস জিতে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে চান।
উদাহরণ:
আইপিএলসহ অনেক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দেখা গেছে, রাতের খেলায় শিশিরের কারণে টস জেতা দল দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে সহজেই রান তাড়া করেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে প্রায় ৫৫% ম্যাচ টস জেতা দলের পক্ষে গেছে।
বিশ্বকাপ ও বড় টুর্নামেন্টে টসের গুরুত্ব
বড় টুর্নামেন্টে টসের ভূমিকা আরও বেশি চোখে পড়ে। কারণ নকআউট পর্বে একবার হারলেই বিদায়। তাই অধিনায়কের টস-সিদ্ধান্ত ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে পারে।
উদাহরণ:
-
২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল (ভারত বনাম নিউজিল্যান্ড): নিউজিল্যান্ড টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ধীরে খেললেও ২৩৯ রান তোলে। ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ সেই লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে চাপে পড়ে এবং ম্যাচ হেরে যায়।
-
১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল (ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা, কলকাতা): শ্রীলঙ্কা টস জিতে ব্যাট করে বড় স্কোর তোলে। পরে ভারতের ইনিংসে চাপে ভেঙে পড়া এবং দর্শক বিশৃঙ্খলা ম্যাচের গতিপথ পাল্টে দেয়।
উপসংহার
সব মিলিয়ে বলা যায়, ক্রিকেট খেলায় টস একটি ছোট কিন্তু গেম-চেঞ্জিং ফ্যাক্টর। টেস্ট ম্যাচে এটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের ভিত্তি গড়ে দেয়, ওয়ানডেতে পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়তি সুবিধা এনে দেয়, আর টি-টোয়েন্টিতে শিশির ফ্যাক্টর একে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
অবশ্যই টস জেতা মানেই ম্যাচ জেতা নয়—কারণ শেষ পর্যন্ত খেলা জেতা নির্ভর করে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স, কৌশল ও মানসিক দৃঢ়তার ওপর। তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে টস যে একটি দলকে বাড়তি সুবিধা এনে দিতে পারে, তা ক্রিকেট ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে।