গ্রামের মাঠে বানানো গোলপোস্টের স্মৃতি
গ্রামের মাঠে বানানো গোলপোস্টের স্মৃতি
গ্রামের মাঠ, খোলা আকাশ, কাদামাটি আর বন্ধুদের কণ্ঠে চিৎকার—এই চিরচেনা দৃশ্যের মধ্যে যে জিনিসটা আমাদের শৈশবকে ফুটবলময় করে তুলেছিল, তা হলো নিজের হাতে বানানো এক টুকরো গোলপোস্ট। শহরের দামি স্টেডিয়াম বা ঝাঁ-চকচকে ফুটবল গ্রাউন্ড নয়, গ্রামের সেই মাটির মাঠেই গড়ে উঠেছে আমাদের খেলার সাম্রাজ্য। আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো বাঁশ, গাছের ডাল, বা পুরনো সাইকেলের রিং দিয়ে বানানো গোলপোস্ট।
গোলপোস্ট বানানোর প্রথম অভিজ্ঞতা
স্মৃতির জানালায় উঁকি দিলে আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, কেমন করে সকালের স্কুল ছুটির পর সবাই ছুটে যেত মাঠে। হাতে থাকত একটা পুরনো বল আর লক্ষ্য—আজ একটা “আসল” গোলপোস্ট বানানো হবে। তখনকার দিনে গোলপোস্ট মানেই ছিলো দুটো সোজা কাঠি বা বাঁশ, মাঝে কোনো ক্রসবার থাকত না। অনেকে আবার দুই পাশে জুতা, ইট কিংবা বই রেখেই গোলপোস্ট বানিয়ে নিত। তবু আমাদের চোখে সেটা ছিলো একেবারে বিশ্বকাপের মতো সম্মানীয় কিছু!
গোলপোস্ট ঘিরে তৈরি হওয়া স্মৃতি
সেই গোলপোস্ট বানানো যেন একটা উৎসব ছিল। কে বাঁশ আনবে, কে মাপ দেবে, কে কাদামাটি সমান করবে—সবাই যার যার দায়িত্বে ব্যস্ত। মাঠ সমান করে লাইন টানা হতো কাঠ কয়লার টুকরো দিয়ে। মাঝে মাঝে মাঠের আশেপাশের গাছ থেকে শুকনো পাতা সরিয়ে নিতে হতো যেন বল কোথাও আটকে না যায়।
গোলপোস্ট তৈরি হয়ে গেলে শুরু হতো খেলা। গোল হলে চিৎকার, মিস হলে আক্ষেপ, আর ফাউল হলে হালকা বাকবিতণ্ডা—সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ। অনেক সময় গোলপোস্ট হেলে পড়লে খেলা থেমে যেত, আবার সবাই মিলে সেটাকে ঠিক করতাম। ওইটুকু পরিশ্রমে যে আনন্দ মিলত, সেটা আজকের প্রজন্মের জন্য হয়তো কল্পনাতীত।
প্রতিযোগিতা আর বন্ধুত্ব
অনেক সময় পাশের পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ম্যাচ হতো। সেই ম্যাচের প্রস্তুতি থাকত কয়েকদিন আগ থেকেই। গোলপোস্ট তখন আরও যত্ন নিয়ে বানানো হতো। বাঁশ ভালোভাবে পুঁতে রাখা হতো মাটিতে, যাতে খেলায় কোনো সমস্যা না হয়। মাঝে মাঝে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক এসে মজা করে বলত, “এইবার যদি গোলপোস্টে বার পাউ, তাহলে তো একেবারে আসল মাঠ মনে হবে!”
এইসব খেলায় হার-জিত থাকলেও বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে বড় জয়। খেলার পর সবাই মিলে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, গাছে উঠে কাঁঠাল চুরি করে খাওয়া, অথবা মাঠের ধারে বসে গল্প করা—সবই ছিল গোলপোস্ট কেন্দ্রিক শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজকের প্রেক্ষাপটে সেই স্মৃতি
আজ গ্রামে অনেক জায়গায় মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে, শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে মোবাইল আর স্ক্রিনের ভিতরে। কিন্তু যারা একসময় গ্রামের মাঠে নিজের হাতে গোলপোস্ট বানিয়ে খেলেছে, তারা জানে শৈশবের সেই দিনগুলো কতটা নির্মল, কতটা আনন্দময় ছিল।
গোলপোস্ট ছিল শুধু খেলার উপকরণ নয়; সেটা ছিল স্বপ্নের প্রতীক, ঐক্যের প্রতীক, আর শৈশবের সেরা স্মৃতিগুলোর প্রতীক। সেই গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা শিখেছিলাম দলবদ্ধভাবে কিছু তৈরি করা, ভাগ করে নেওয়া, এবং আনন্দ খুঁজে পাওয়া ছোট ছোট সাফল্যে।
উপসংহার
গ্রামের মাঠে বানানো গোলপোস্টের স্মৃতি একধরনের অমূল্য রত্ন। এটা শুধু খেলার স্মৃতি নয়, এটা এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার গল্প। আজও যদি চোখ বন্ধ করি, কানে ভেসে আসে সেই চিৎকার—“গোওওল!” আর মনের ভেতর জেগে ওঠে এক টুকরো সোনালি শৈশব, যেখানে আমরা সবাই ছিলাম একেকজন ফুটবল তারকা।